বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ
শ্রদ্ধাঞ্জলি
আনোয়ারুল হক
আজ আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ’র জন্মদিন। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই কবিকে। তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার মুগ্ধ পরিণয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে আমি যখন বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়ি তখন থেকে।
৬৯’এ ভিক্টোরিয়া কলেজে পা দিয়েছি। তরল আগুন সময়। তারপর একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার পর সাহিত্যাঙ্গনে আমরা যখন কলেজ রোডে ‘সুখেনের চা’য়ের দোকান, জলযোগ, সুইটহোম, পেড়া ভাণ্ডার, স্টেশন রোডে হোটেল আবেদীন- এইসব চা’য়ের দোকানগুলিকে প্রায় নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছি আড্ডায়, তখন আমাদের হাতে থাকতো নিজের লেখা কবিতা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে থাকতো আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান এঁদের কবিতার বই।
৭৩ সালে কুমিল্লা টাউনহলে ‘কবি সম্মেলন’ হলো। আয়োজক ছিল আমার বন্ধু প্রয়াত কবি ও সংগঠক ফখরুল হুদা হেলাল ও কবি ফখরুল ইসলাম রচি এদের সংগঠন ‘সে আমি তুমি’। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি তাঁরা সকলেই দুইদিনের কবি সম্মেলনে ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন।
এই সম্মেলনের পর থেকে আমরা কবিতার প্রতি আরো বেশি নিবেদিত হয়েছিলাম। এর আগে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশি’। এতে আমি জড়িত ছিলাম। হলেও আমাদের সকলের আনন্দ অংশগ্রহণ, সহায়তা ছিল ‘কবি সম্মেলন’কে সফল করার জন্য।
এইসব আয়োজন, কবিতা, টাউনহল মঞ্চে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবে বেশি ইনভলব থাকাতে কারো কারো ক্লাশে নিয়মিত ছিলাম না। ফলে ‘দিল আফরোজ ম্যাডাম’র টিউটোরিয়াল দেওয়া হচ্ছিল না। তিনি আমার নাগাল পান না। আমিও তাঁকে এড়িয়ে চলি। একদিন ধরা পড়ে গেলাম। বললেন, তুমি যদি আজকে পরীক্ষা না দাও, তাহলে তোমাকে শূন্য দিয়ে রাখবো।
হুমকিটা যদিও ছিল স্নেহের, মনে হলো, আর ফাঁকি দেওয়া ঠিক না। বললাম, কবে পরীক্ষা দিতে হবে। বললেন, আজই। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। বললাম, ঠিক আছে। বিষয় এবং প্রশ্ন দিন। ম্যাডাম সেমিনার কক্ষে আমাকে বসিয়ে প্রশ্ন দিলেন, ‘কবিতা’র সংজ্ঞাসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাও।
এই প্রশ্ন ! তখনও আমার ঝোলা ব্যাগে আল মাহমুদের কবিতার বই। ম্যাডাম খোঁচা দিলেন, খুব তো কবিতা নিয়ে দিনরাত পড়ে আছো। দেখি কী লিখো ! এদিকে আমি তো মনে মনে খুশি।
প্রথম টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দিলাম। লিকলাম, মনের মতো করে আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’ কবিতাটা। মুখস্থ ছিল। ব্যাখ্যাসহ তুলে দিলাম।
ম্যাডাম সামনে চেয়ারে বসা ছিলেন। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল। তাকিয়ে আছেন। লেখা শেষ করে খাতাটা হাতে দিতে সাথে সাথেই পড়লেন। নম্বর কত দিলেন জানিনা। বললেন, যাও এবার, বাঁদঅ (ম্যাডাম ‘র’ উচ্চারণ করতে পারতেন না। শুনেছি রংপুরের মানুষ নাকি ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না) ছেলে !
আমার প্রিয় কবিতা : প্রত্যাবর্তনের লজ্জা
আল মাহমুদ
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান ...।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
তুলে ফেলবো ঘষে ঘষে।
১১/০৭/২০২৫
আনোয়ারুল হক: সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ
আজ আমার প্রিয় কবি আল মাহমুদ’র জন্মদিন। আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই কবিকে। তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার মুগ্ধ পরিণয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে আমি যখন বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়ি তখন থেকে।
৬৯’এ ভিক্টোরিয়া কলেজে পা দিয়েছি। তরল আগুন সময়। তারপর একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার পর সাহিত্যাঙ্গনে আমরা যখন কলেজ রোডে ‘সুখেনের চা’য়ের দোকান, জলযোগ, সুইটহোম, পেড়া ভাণ্ডার, স্টেশন রোডে হোটেল আবেদীন- এইসব চা’য়ের দোকানগুলিকে প্রায় নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছি আড্ডায়, তখন আমাদের হাতে থাকতো নিজের লেখা কবিতা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে থাকতো আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান এঁদের কবিতার বই।
৭৩ সালে কুমিল্লা টাউনহলে ‘কবি সম্মেলন’ হলো। আয়োজক ছিল আমার বন্ধু প্রয়াত কবি ও সংগঠক ফখরুল হুদা হেলাল ও কবি ফখরুল ইসলাম রচি এদের সংগঠন ‘সে আমি তুমি’। যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি তাঁরা সকলেই দুইদিনের কবি সম্মেলনে ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন।
এই সম্মেলনের পর থেকে আমরা কবিতার প্রতি আরো বেশি নিবেদিত হয়েছিলাম। এর আগে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘আমরা জ্যোৎস্নার প্রতিবেশি’। এতে আমি জড়িত ছিলাম। হলেও আমাদের সকলের আনন্দ অংশগ্রহণ, সহায়তা ছিল ‘কবি সম্মেলন’কে সফল করার জন্য।
এইসব আয়োজন, কবিতা, টাউনহল মঞ্চে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবে বেশি ইনভলব থাকাতে কারো কারো ক্লাশে নিয়মিত ছিলাম না। ফলে ‘দিল আফরোজ ম্যাডাম’র টিউটোরিয়াল দেওয়া হচ্ছিল না। তিনি আমার নাগাল পান না। আমিও তাঁকে এড়িয়ে চলি। একদিন ধরা পড়ে গেলাম। বললেন, তুমি যদি আজকে পরীক্ষা না দাও, তাহলে তোমাকে শূন্য দিয়ে রাখবো।
হুমকিটা যদিও ছিল স্নেহের, মনে হলো, আর ফাঁকি দেওয়া ঠিক না। বললাম, কবে পরীক্ষা দিতে হবে। বললেন, আজই। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। বললাম, ঠিক আছে। বিষয় এবং প্রশ্ন দিন। ম্যাডাম সেমিনার কক্ষে আমাকে বসিয়ে প্রশ্ন দিলেন, ‘কবিতা’র সংজ্ঞাসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাও।
এই প্রশ্ন ! তখনও আমার ঝোলা ব্যাগে আল মাহমুদের কবিতার বই। ম্যাডাম খোঁচা দিলেন, খুব তো কবিতা নিয়ে দিনরাত পড়ে আছো। দেখি কী লিখো ! এদিকে আমি তো মনে মনে খুশি।
প্রথম টিউটোরিয়াল পরীক্ষা দিলাম। লিকলাম, মনের মতো করে আল মাহমুদের ‘কবিতা এমন’ কবিতাটা। মুখস্থ ছিল। ব্যাখ্যাসহ তুলে দিলাম।
ম্যাডাম সামনে চেয়ারে বসা ছিলেন। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল। তাকিয়ে আছেন। লেখা শেষ করে খাতাটা হাতে দিতে সাথে সাথেই পড়লেন। নম্বর কত দিলেন জানিনা। বললেন, যাও এবার, বাঁদঅ (ম্যাডাম ‘র’ উচ্চারণ করতে পারতেন না। শুনেছি রংপুরের মানুষ নাকি ‘র’ উচ্চারণ করতে পারে না) ছেলে !
আমার প্রিয় কবিতা : প্রত্যাবর্তনের লজ্জা
আল মাহমুদ
শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান ...।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসে ফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
তুলে ফেলবো ঘষে ঘষে।
১১/০৭/২০২৫
আনোয়ারুল হক: সাবেক অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ