হোম > মতামত

কলসিন্দুর থেকে পাহাড় ছুঁয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নারী ফুটবল

ভাস্কর মজুমদার

আপডেট: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১২: ৩০

বৃষ্টিভেজা এক সকাল। ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের স্কুল মাঠে একদল মেয়ে ছেঁড়া বল নিয়ে ছুটছে। গায়ে সাদা-নীল ইউনিফর্ম, কারও পায়ে জুতা নেই, কারও হাতে বইয়ের বদলে বল। দূর থেকে কে যেন হাঁক দেয়, ুএই মেয়ে, বল ফেলে ঘরের কাজ কর!” কেউ শুনে না, শুনলেও গায়ে মাখে না। কারণ ওরা জানে, কোনো একদিন এই বলটাই তাদের জীবন পাল্টে দেবে।

কেউ জানত না, সেই কলসিন্দুর থেকেই একদিন উঠে আসবে সানজিদা, মারিয়া, তহুরারা। সেই মাটিতেই গড়ে উঠবে এমন এক দল, যারা শুধু গোল করবে না, করবে ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের পেছনে ছিল অবহেলা, ছিল সমাজের চোখরাঙানি, ছিল ক্ষুধা আর লজ্জার দেয়াল—যা একে একে ভেঙেছে তারা।

ঋতুপর্ণা চাকমা তখনো জাতীয় দলে ডাক পায়নি। রাঙামাটির পাহাড়ি পথ পেরিয়ে স্কুলে যেত। মায়ের মুখে শুনত, ুখেলা-ধুলা করে কী হবে মা? সংসার চালাতে পারবি?” বাবা থাকতেন চুপ, কেবল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন দীর্ঘক্ষণ। ঋতুপর্ণার হাতে কোনো স্পনসর ছিল না, ছিল না ভালো জুতা, ছিল না প্র্যাকটিসের মাঠ। তবু সে খেলত। খেলত কারণ সে বিশ্বাস করত—এই খেলাটাই তার মুক্তির পথ।

ওদিকে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটির দূর পাহাড়েও একই আগুন ছড়াচ্ছিল। বল হাতে খেলতে বের হতো আংচিং মারমা, উনসাই মারমারা। স্কুলের পর রান্না, আবার প্র্যাকটিস। সন্ধ্যায় আলো চলে গেলে কেরোসিনের বাতিতে বই পড়া। তবু মুখে কখনো ুপারবো না” শব্দটা আসেনি।

তাদের কোনো মিডিয়া কাভারেজ ছিল না, কেউ জানত না তাদের নাম। তবু তারাই একদিন হয়ে উঠে বাংলাদেশের গর্ব।

যখন ২০২২ সালে কাঠমাণ্ডুতে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো সাফ নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলো, তখন দেশের লাখো মানুষের চোখে জল এসেছিল। কারণ এই মেয়েরা এসেছিল তৃণমূল থেকে, এসেছে না খেয়ে খেলা শেষ করে বাড়ি ফিরে খালি থালার সামনে বসা জীবন থেকে।

কিন্তু গল্পটা সেখানে থামেনি।

২০২৪ সালে, সেই কাঠমাণ্ডুর মাঠেই বাংলাদেশ আবারো সাফ জিতল। রুপনা চাকমা, যিনি একসময় বান্দরবানে প্র্যাকটিস করতে গিয়ে অপমান আর নিরুৎসাহের মুখোমুখি হতেন, তিনিই দাঁড়িয়ে থেকে গোলবার বাঁচালেন একের পর এক আক্রমণ। ঋতুপর্ণা চাকমা—সে তখন মায়ানমারের বিপক্ষে ম্যাচে গোল করে নিজের নাম তুলছে জয়তালিকায়, সেই খবর প্রথম আসে মাঠে বসা তার বাবা-মার চোখে জল হয়ে।

এরই মধ্যে মেয়েরা পা রাখে বড় মঞ্চে—এএফসি নারী এশিয়ান কাপ। ইয়াঙ্গুনে অনুষ্ঠিত গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের মেয়েরা ঝড় তোলে। প্রথম ম্যাচে ৭ু০ গোলে জয়, পরেরটিতে মায়ানমারকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। কে ভাবতে পারত কয়েক বছর আগে যে এই দেশের মেয়েরা এশিয়ান কাপের মূল পর্বে খেলবে? অথচ এখন তারা শুধু এশিয়ান কাপই নয়, তাকিয়ে আছে আরও দূরে—বিশ্বকাপের দিকে।

তাদের এই জয়ে কেউ বড় বিজ্ঞাপন দেয়নি, পোস্টারে ছবি ছাপে না প্রতিদিন, কিন্তু তাদের মুখে যে সাহস, সেটার দাম কোনো বিলবোর্ডে মেলে না।

তারা জানে, বিশ্বকাপ খেলতে গেলে এশিয়ার শীর্ষ ছয় হতে হবে। সেটা কি খুব দূরের স্বপ্ন?

না। কারণ যারা খালি পায়ে পাহাড় বেয়ে অনুশীলনে যায়, তারা মাঠে দাঁড়িয়ে বিশ্বকে থমকে দিতে পারে।

তাদের গল্পগুলো শুনলে বোঝা যায়, ফুটবলটা ওদের কাছে কেবল খেলা নয়। এটা প্রতিবাদ। এটা আত্মরক্ষা। এটা নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার পথ।

যে সমাজ একদিন বলেছিল, "মেয়ে হয়ে খেলতে যাবে?"

সেই সমাজই আজ বলে, "দেখেছিস, আমাদের মেয়েরা কী খেলছে!"

আর সবচেয়ে সুন্দর হয় তখন, যখন গ্রামের সেই মেয়েটার মা বলে, ুআমার মেয়ের ডাক এসেছে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনায়।”

তখন রান্নাঘরের গন্ধে শুধু ভাতের বাষ্প নয়, মিশে থাকে গর্বের ধোঁয়া।

বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল এখন আর শুধু খেলোয়াড় নয়, তারা আমাদের প্রতিচ্ছবি। তারা আমাদের ঘুমপাড়ানি অভিমানকে, নিঃশব্দ প্রতিবাদকে, হার না মানা ভালোবাসাকে মাঠে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।

তারা আমাদের শেখায়—স্বপ্ন সত্যি হয়, যদি তোমার ইচ্ছা পাহাড়ের চেয়েও বড় হয়।

তাই বলি—

জাগো নারী, জাগো অগ্নিশিখা।

তোমাদের পায়ে যতক্ষণ বল থাকবে, ততক্ষণ এই জাতির গর্ব নিভে যাবে না।৷

ভাস্কর মজুমদার : পুরাতন চৌধুরী পাড়া, কুমিল্লা। মহা ব্যাবস্থাপক ব্র‍্যাক আড়ং ও সাবেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

জুলাই ডায়েরি

লাইফ ইজ নট অ্যা ব্যাড অফ রোজেস!

জিপিএ ফাইভ এবং প্রজন্মের গন্তব্য!

কবি আল মাহমুদের জন্মদিনে

সেকশন